পাবলো পিকাসো (Pablo Picasso)


 শিল্প-সাহিত্যের সৈকতে হাজারো পথিক আসে। কিন্তু এই সৈকতের বেলাভূমি বড় স্বার্থপর। সে শুধু তাদেরই স্মরণ করে যে তার হৃদয় কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিতে পেরেছে। সর্বস্ব বিলীন করে শিল্প-সাহিত্যের সৈকত থেকে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। তারপরও এ পৃথিবীতে যেমন বিলীন হয়ে যায় স্বপ্ন, তেমনি স্বীকৃতির পরও অনেক শিল্পীর নাম সহজেই ভুলে যাই। অন্য কেউ না, আমরাই ভুলে যাই।


ভুলে যাওয়াটাই আমাদের স্বভাব। আর ভুলতে পারি বলেই নতুন কিছু ধারণ করতে পারি। কিন্তু কোন কোন মনীষীদের কখনো ভুলতে পারি না। তাদের স্মরণ করে শ্রদ্ধায় মাথা অবনত করতে হয়। বিশ্বধরিত্রী তাদের গর্ভে ধারণ করে ধন্য হয়েছে। তাদের কর্মমুখর জীবনে তৃপ্ত হয়েছে প্রকৃতি ও সভ্যতা। তাদের কর্মপ্রচেষ্টার ফলেই আজ শিল্প-সাহিত্যের চরম উৎকর্ষতার যুগে আমাদের বসবাস। সময় চলে যাবে, কাল অতিবাহিত হবে, কিন্তু পৃথিবী যতোদিন আছে, তাঁরাও পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন। তাঁদের অবদানে সভ্যতার পতাকা আজও মাথা উঁচু করে অস্তিত্বের জানান দিতে পারছে। মৃত্যুকে শুধু সেই মহামানব জয় করতে পারে। যার অবদানের স্বীকৃতি দিতে সারা জীবন পৃথিবী কাঙাল হয়ে থাকে। সে মহামানব আর কেউ নয়, পাবলো পিকাসো। যাঁকে গর্ভে ধারণ করে স্পেন ধন্য হয়নি, বরং বিখ্যাতও হয়েছে। যাঁকে আশ্রয় দিয়ে ফ্রাঞ্চও কিছুটা গর্ব করাটাই স্বাভাবিক। সেই পাবলো পিকাসোর কথাই বলছি।


পিকাসোর মূল স্প্যানিশ নাম পাবলো রুইজ পিকাসে। জন্ম ২৫ অক্টোবর ১৮৮১। বাল্যকাল স্পেনেই কাটান। কৈশোরে উচ্চশিক্ষার জন্য ফ্রাঞ্চে পাড়ি জমান। বৈচিত্র্যময় তাঁর জীবন। ভাস্কর্য নির্মাণ, স্টেজ তৈরি, পত্রিকা অলঙ্করণের কাজ করলেও মূলত চিত্রকর্মই ছিল তাঁর নেশা। তাঁর চিত্রকর্মময় জীবন কয়েকটি কালে বিভক্ত। তাঁর অতি বিখ্যাত তিনটি কাল ‘দ্যা রোজ পিরিয়ড, ‘দ্যা ব্লু পিরিয়ড এবং ‘দ্যা কিউবিস্ট পিরিয়ড।~ এই সময়ে তাঁর অঙ্কনে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখা যায়। তিনি তাঁর প্রচ- পরিশ্রম ও আত্মপ্রত্যয়ে বিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী রূপে আভির্ভূত হতে সক্ষম হন।


প্রাথমিক জীবন ঃ স্পেনের আন্দালুসিয়া রাজ্যের মালাগা শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। পরিবারের ধর্মবিশ্বাস ব্যাপটিস্ট। তাঁর পিতাও একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন। তিনি স্থানীয় মিউজিয়াম স্কুলের আর্ট শিক্ষক ছিলেন। বাল্যকালেই অঙ্কনের প্রতি প্রচুর ঝোঁক ছিল পিকাসোর। তাঁর মুখের প্রথম শব্দই ছিল; ‘পিজ, পিজ।~ যা স্প্যানিশ শব্দ ‘লিয়াপিজের~ সংক্ষিপ্ত রূপ। আর লিয়াপেজ অর্থ পেন্সিল। চিত্রকর্মের প্রতি দারুণ আগ্রহের ফলে মাত্র আট বছর বয়সেই পিকাসো ক্ল্যাসিকাল চিত্র অঙ্কন শিখেন। তখন পর্যন্ত বাবাই তাঁর একমাত্র শিক্ষক। পিকাসোর বাবা রুইজ বিশ্বাস করতেন ‘অঙ্কনের ধারাবাহিক প্রচেষ্টাই মানুষকে চিত্রকর্মে দক্ষ করে তুলে।~ তাই পিকাসোকে তিনি চিত্র অঙ্কনে সর্বক্ষণিক ব্যস্ত রাখলেন। ১৮৯১ সালে পিকাসের পরিবার কাউরোনিয়াতে স্থানান্তরিত হয়। বাবা একটি চারুকলা কলেজের শিক্ষকতার চাকরি নেন। কাউরোনিয়াতে অবস্থানকালে একদিন রুইজ দেখলেন পিকাসো তার আঁকা অসম্পূর্ণ একটা পেঙ্গুইন পরিপূর্ণ আঁকছে। ছেলের অঙ্কনের দক্ষতা দেখে রুইজ অবাক। বুঝলেন তেরো বছরের কিশোর দক্ষতায় তাকেও অতিক্রম করেছে। তাই বাবা পিকাসোকে চিত্রকর্ম অঙ্কণ চর্চায় ভালোভাবে মনোনিবেশ করালেন।


এ সময় গুটি বসন্তে পিকাসোর বোনের মৃত্যু হয়। বোনের মৃত্যুর পর পিকাসোর পরিবার বার্সেলোনাতে বসবাস শুরু করে। রুইজ বার্সেলোনার ‘স্কুল অব আর্ট কলেজে~ আবার শিক্ষকতার চাকরি নেন। কিছুদিন পর রুইজ ছেলেকে কলেজে ভর্তি করাতে কলেজ-কর্মকর্তাদের প্রতি অনুরোধ জানান। মাত্র তেরো বছরের কিশোরও চারুকলা কলেজে ভর্তি হতে পারে এমনটা কর্তৃপক্ষের কল্পনাতীত ছিল। তারপরও তারা তাকে ভর্তি পরীক্ষার অনুমতি দেয়। ভর্তি পরীক্ষায় নির্বাচিত হতে সাধারণ ছাত্রদের ন্যূনতম এক মাস লাগত। কিন্তু মেধাবী পিকাসোর মাত্র এক সপ্তাহের প্রয়োজন হয়। তেরো বছর বয়সের কিশোর অঙ্কন ও চিত্রশিল্পের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করতে সক্ষম হয়। পিকাসোর কাজের একাগ্রতার জন্য বাবা একটি নতুন ঘর ভাড়া নেন।


কর্মজীবনের শুরু ঃ ষোল বছর বয়সে বাবা ও চাচা তাকে ‘মাদ্রিদ অ্যাকাডেমি অব স্যান ফারনার্ন্দো আর্টস্কুলে~ পাঠায়। কিন্তু পিকাসো সবসময়ই প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা ঘৃণা করত। তারপরও প্রথম ১৯০০ সালে ফ্রাঞ্চে পাড়ি জমান। বন্ধু কবি ম্যাক্স জ্যাকব তাকে ফ্রেঞ্চ শিখতে সহায়তা করে। একসময় তিনি ম্যাক্সের সাথে থাকতে শুরু করে। কিন্তু ম্যাক্সের সাথে তেমন মানাতে পারেননি। তবু প্রথম পাঁচ মাস উন্নাসিক বন্ধুর সাথে থাকতেই হয়। দিনে ঘুমিয়ে রাতে ছবি অঙ্কনের জন্য একরাতে ম্যাক্স তাকে চড় মারে। এ ধরনের ছোটখাটো বিষয় দুজনার মাঝে লেগেই থাকত।


কর্মজীবনের শুরুতে তাকে দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হতে হয়। নজরুলের মতো তিনি ঘোষণা করেননি, ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছে মহান/ তুমি মোরে দিয়াছ খৃষ্টের সম্মান।~ কিন্তু এ দারিদ্র্যই জীবন নামের ভয়ঙ্কর সত্যের মুখোমুখি হতে সাহস জোগায়। দারিদ্র্যকে জয় করার প্রত্যয়ে কাজ খুঁজতে থাকেন। তবু সহজে কাটছিল না দারিদ্র্যের আঁধার। ফ্রাঞ্চের সেই ভাড়া করা ছোট ঘরটাকে উষ্ণ রাখতে নিজের অনেক চিত্রকর্ম পুড়িয়ে ফেলতে হয়। তারপর একটা ম্যাগাজিন ‘আরতে জোভানের~ সাথে যুক্ত হন। বন্ধু ম্যাক্স সোলার পত্রিকার লেখা সংগ্রহ করত। আর পিকাসো অলঙ্করণের কাজটুকু করতেন। পত্রিকাটির মাত্র পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রথম ইস্যু ৩১ মার্চ ১৯০১ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারেননি। বাধ্য হয়েই ১৯০৭ সালে পিকাসো ড্যানিয়েল হেনরির আর্ট গ্যালারিতে যোগ দেন। এসময় তিনি অনেক বন্ধুর সাথে পরিচিত হন। যাদের মধ্যে আন্দ্রে ব্রেটন, গুইলাম এপোলিনিয়র, আলফ্রেড জেরি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তারপর আর তাকে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।


নারীর ভূমিকা ঃ নারীর ভূমিকা সব শিল্পীর জীবনেই ব্যাপক প্রভাব ফেলে। পিকাসোও এর ব্যাতিক্রম নয়। বিশ শতকের কিছুটা সময় তিনি মাদ্রিদে আর কিছুকাল তিনি প্যারিসে কাটান। এ সময় তাঁকে ভালবাসার স্নিগ্ধ সৈকতে পা ফেলতে হয়। ভাসতে হয় প্রেমের ভেলায়। তিনি ১৯০৪ সালে ফার্নানান্দে অলিভারের প্রেমে পড়েন। তুমুল চলছিল প্রাথমিক দিনগুলো। কিন্তু কিছু কাল না যেতেই তিনি মারসেল হামবার্টের প্রেমে পড়েন। যার অনেক ছবিই তিনি কিউবিস্ট পিরডে এঁকেছেন। এ নারী পিকাসোর জীবনকে ভালাবাসর বৃষ্টিতে ভিজেয়ে দেয়। ব্যক্তি জীবন, চিত্রকর্ম ও আঁকাআাঁকিতে নতুন বাঁক মূলত পিকাসো তার সাথে সম্পর্ককালীন সময়েই হয়। পিকাসো মারসেলের সাথে তার প্রেম অনেক চিত্রকর্ম তুলে ধরেন। কিন্তু ১৯১৫ সালে তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে পিকাসো ভেঙে পড়েন।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তার প্রেমিক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি অনেক নারীর সাথে সর্ম্পকে জড়িয়ে পড়েন। সারজে দিয়াগিলেভ, জুয়ান কচটুয়ে, জিয়েন হুগো ও জুয়ান গ্রিস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯১৮ সালের গ্রীষ্মে তিনি অলগা খোখলভাকে বিয়ে করেন। তাঁরা চিলিতে নিজেদের হানিমুন সম্পন্ন করেন। চিলিয়ান কিছু পৃষ্ঠপোষক, স্ত্রী ও ইগুইনা ইরাজুরাইজ ১৯২০ সালে সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সে সময় তিনি পল নামের এক সন্তানের জনকও হন। কিন্তু তারপরও বিবাহ বেশি দিন টিকেনি। স্বামী-স্ত্রী দুই জনই দুই মেরুর বাসিন্দা। স্ত্রী চাইত প্রাচুর্য আর পিকাসোর স্বপ্ন চিত্রকর্ম। তাই তিনি আবার অন্য নারীর দ্বারস্থ হন। ১৯২৭ সালে পিকাসো ১৭ বছর বয়স্কা ম্যারি থিয়েরাস ওয়াল্টারের সাথে গোপন অভিসার শুরু করেন। এ সময় খোখলভা পৃথক হতে চাইলেও পিকাসো ডিভোর্স দিতে রাজি হয়নি। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাদের বিবাহের সর্ম্পক ছিল। ম্যারি পিকাসের ভালোই সঙ্গ দেয়। ম্যারির সাথে পিকাসোর সর্ম্পক সবচেয়ে দীর্ঘ। এ যুগলের ঘরে মায়া নামের একটি কন্যারও জন্ম হয়। ম্যারি আশা করেছিল পিকাসো তাকে একসময় বিয়ে করবে। কিন্তু পিকাসো তা করেনি। পিকাসোর মৃত্যুর পর সমাজের সমালোচনা সহ্য করতে না পেরে ম্যারি আত্মহত্যা করে।


১৯৪৪ সালে ফ্রাঞ্চের স্বাধীনতার সময় পিকাসোর বয়স ৬৩। তখনও এক তন্বী-তরুণী ছাত্রীর সাথে নতুন করে প্রেমে জড়ান। তার সেই প্রেমিকা ছাত্রীর নাম ফ্রেঙ্কস গিলট। পিকাসোর তুলনায় ৪০ বছরের কনিষ্ঠ হলেও তাদের প্রেমিক জুটি ছিল অসাধারণ। এমনকি ক্লড ও পলেমা নামের তাদের দুসন্তানও ছিল। পিকাসোর বয়স বাড়ার সাথে সাথে তরুণীর প্রতি তার আকর্ষণও বাড়ে। তার অনেক চিত্র কর্ম, তৈল চিত্র, ভাস্কর্য ও ছবিতে অনেক সুন্দরী মেয়ে বন্ধুদের ছবি ফুটে ওঠে। এমনই একটি ছবি ‘নাড উইমেন।~ যাকে কেউ বলেন নারীর হিংস্রতার ছবি। আবার কেউ বলেন নারীকে এখানে লোভের প্রতীক রূপে ব্যবহার করা হয়েছে। যে যাই বলুক সারা পৃথিবীতে এটি ভালো আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়।


চিত্রকর্ম ঃ শীল্প সম্পর্কে পিকাসোর মন্তব্য, ‘শিল্প বা চিত্রকর্ম একটি মিথ্যা যা আমাদের সত্য বুঝতে সাহায্য করে।~ তারপরও এ মিথ্যের চর্চা অব্যাহত রাখেন সত্যকে আবিষ্কার করতে। ১৯০১-১৯৫০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত চিত্র অঙ্কন করতে থাকেন। জীবন সংগ্রামের সাথে মুখোমুখি হন। চিত্রকর্মে আনেন ব্যাপক পরিবর্তন-পরিবর্ধন। চারুকলায় চালান পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তার চিত্রকর্মের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার কালকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয় । ব্লু পিরিয়ড ঃ পিকাসোর ব্লু পিরিয়ডের সময়কাল ছিল ১৯০১-১৯০৪। তাঁর এ সময়কার চিত্রকর্ম সবই বিষণœতায় আছন্ন। যার শেডগুলো নীল, সবুজ আর ঘটনাক্রমে তাতে অন্য রঙেরও সংযোজন করা হতো। এ ধরনের ছবি অঙ্কনের নির্দিষ্ট কারণ ছিল। ১৯০১ সালে স্পেনে থাকাকালে এই ধরনের ছবি অঙ্কনের শুরু। এই সময় অনেক মাই তাদের কোলের শিশুকে নিয়ে পরকীয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সমাজে দেখা দেয় চরম অবক্ষয়। পতিতাবৃত্তি ও ভিক্ষাবৃতি একটি ভালো পেশায় পরিণত হয়। এ সময়কালে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছবি ‘ল্যা ভাই।~


বর্তমান স্থান ঃ ক্লিভল্যান্ড মিউজিয়াম অব আর্ট, স্পেন এই ছবিটি অঙ্কনের ভুমিকা মূলত পিকাসোর বন্ধু কেসামেগাসের মৃত্যু। যে ১৯০১ সালে আত্মহত্যা করে। এটা তাঁর ব্লু পিরিয়ডের সর্বাধিক জনপ্রিয় একটি ছবি। এই ছবিতে পিকাসো কি বুঝাতে চেয়েছেন?


ছবির মধ্যের ব্যক্তিটির পেছনে স্টুডিওতে আঁকা অঙ্কিত স্বামী-স্ত্রীর ছবি। মা তার সন্তানকে কোলে রেখে সে প্রেমিক- প্রেমিকাকে দেখছে। তারা সবাই কাছাকাছি। কিন্তু তারপরও তাদের অবস্থানগত কারণে বিচ্ছিন্ন। আর এই নীল রংই বড় ধরনের বিচ্ছেদ মা ও প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে দেখাচ্ছে। যা মাকে তাদের পরকীয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হাতছানি দিচ্ছে। সেই সাথে তাদের পাশাপাশি থাকা অন্যান্য নগ্ন যুগলদের ছবি তাদের আরো লাগামছাড়া হতে উৎসাহিত করছে। মোট কথা একটি সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র।


রোজ পিরিয়ড ঃ পিকাসোর রোজ পিরিয়ডের সময়কাল ১৯০৪-১৯০৬। যা খুবই মনমুগ্ধকর স্টাইল, কমলা ও গোলাপি এবং অনেক হাস্যকর, শারীরিক কসরতকারী মানুষ ও ভাঁড়ের চরিত্র অঙ্কনে বৈশিষ্ট্যময়। পিকাসো তখন প্রতিভাবান শিল্পী ও পরবর্তিতে তার স্ত্রী ফার্নান্দের প্রেমে পড়ে। পিকাসোর অনেক ছবিই তার সাথে উষ্ণ সম্পর্কের প্রতিফলন। এর প্রায় প্রতিটিতেই ফ্রাঞ্চের চিত্রকর্মের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। তার এ সময়ের বিখ্যাত ছবি ‘গ্যারাকন এ লা পাইপ।~


পিকাসোর রোজ পিরিয়ডের ছবিগুলোতে মানুষকে আনন্দের কারখানায় উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। প্যারিসের মন্টামারিতে অবস্থানকালে তিনি এই ছবি আঁকেন। চিত্রে অঙ্কিত ছেলেটি পিকাসোর একজন ভক্ত। যার চারপাশের ফুল তার মাত্রাতিরিক্ত আনন্দ চিত্রায়িত করছে। ২০০৪-এ গ্যারাকন এ লা পাইপ রেকর্ড পরিমাণ দামে ১০৪ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়।


এর কিছুদিন পর ১৯০৭ সালে তাঁর ছবি নতুন বাঁকে মোড় নেয়। তিনি আফ্রিকান চিত্রকর্মের স্টাইলে অনেকটা প্রভাবিত হন। যার শ্রেষ্ঠ ফসলস্বরূপ তিনি ‘ল্যাস ডিমলসেলসড এভিগননের~ মতো ছবি আঁকতে সক্ষম হন। এই একটি ছবি সারা পৃথিবীতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।


এর মাধ্যমেই বিশ্লেষণধর্মী কিউবিজম চিত্রকর্মের কাজ শুরু করেন পিকাসো। পিকাসোর প্রাথমিক ছবির তুলনায় এতে ভিন্নতা দেখা যায়। তার স্পেনীয়, লাইবেরিয়ান এবং আফ্রিকান অঙ্কনের অভিজ্ঞতার ফলে তিনি পশ্চিমা স্টাইল বা রীতিকে অতিক্রম করে ভিন্ন ধরনের ছবি আঁকতে সক্ষম হন। তবে ছবির মধ্যের মেয়েটির অঙ্কনে স্পষ্টতই তুর্কি শিল্পী ডমিনিক এঙরিসের প্রভাব বোঝা যায়। কিন্তু তার পাশের দুই মহিলা কিন্তু সম্পূর্ণ দেখতে অন্যরকম। অ্যাপলনিয়ের ও জর্জ ব্রাকুই প্রথমে এই ছবিটির সমালোচনা করেন। অবশ্য পরবর্তীতে তারা পিকাসোর ধারণার সাথে একমত হন।


কিউবিজম ঃ বিশ্লেষণধর্মী কিউবিজম চিত্রকর্ম তাকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে দেয়। এই কিউবিজম পিরিয়ড ১৯০৯-১৯১২ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। পিকাসো তাঁর বন্ধু জর্জস ব্রাকুই-এর সহায়তায় হালকা খয়েরি কালার ও ছাই রঙের সমন্বয়ে এ শিল্পকর্ম প্রবর্তন করেন। এদের প্রত্যেকেই বিশ্লেষণধর্মী থিম তাদের চিত্রে অ্যাবস্ট্রাক্রট রূপে উপস্থাপন করত। পিকাসো ও ব্রাকুই-এর ছবি তখন প্রায়ই একই ধরনের ছিলো। যাতে বিভিন্ন স্টাইল প্রবর্তন করা হয়। যেমন ঃ কাটিং পেপার, ছেঁড়া কাগজ, পত্রিকার অংশবিশেষের মাধ্যমে চিত্র তৈরি করা হত। এটাই ছিল সর্বপ্রথম চারুশিল্পে তুলির পরিবর্তে অন্যকিছু ব্যবহার করে চিত্র নির্মাণের প্রথম প্রচেষ্টা। এ সময়কার তার জনপ্রিয় ছবি ‘গোয়েরনিকা।~


স্পেনের এটি জাতীয় সম্পদরূপে বিবেচিত। কালো, ছাই রঙ এবং সাদার সংমিশ্রণে তৈরি এই ছবিটি স্পেনের গৃহযুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র উপস্থাপন করে। বাসকুয়ে শহরের গোয়েরনিকা এলাকার বোম্বিং-এর করুণ চিত্র এটি। যার শিকার সাধারণ মানুষ। এই স্মৃতিচারণমূলক ছবি ভয়াবহ দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, গুম ইত্যাদিকে ভালোভাবে তুলে ধরেছে। ১৯৩৭ সালে স্প্যানিশ গণতান্ত্রিক সরকার এই ছবিটি প্রদর্শনের অনুমতি দেয়। এটা এক ধরনের প্রতীকী ছবি। যার মাঝে বাল্বের আলোতে হিংস্রতা চিত্রায়িত হচ্ছে, যা দর্শককে বোমার চিত্র ভাবাতে সাহায্য করে। বিশ্বব্যাপী এই ছবি প্রদর্শনের পর এটি শান্তির প্রতীক রূপে পরিচিতি পায়।


শেষজীবন ঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পিকাসো প্যারিসেই ছিলেন। পিকাসের শৈল্পিক মন কখনো নাজি সরকারের চাপে বিলীন হয়নি। তিনি কখনো কখনো গেস্টাপো দ্বারা নির্যাতিতও হয়েছেন। ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৫৯ সালে তিনি ৩০০-এর বেশি কবিতা লিখেছেন। যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার একজন মানুষ পিকাসো। তিনি কোরীয় যুদ্ধ নিয়ে যেমন ছবি এঁকেছেন, তেমনি স্পেনের গৃহযুদ্ধের নির্মম ভয়াবহতাও তাঁর তুলির চোখ এড়ায়নি। ফ্যাসিজমের চরম বিরোধী ছিলেন তিনি। ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের তুলনায় কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র বা কমিউনিজম সমর্থন করতেন। তিনি প্রকাশ্যে ফ্রাঞ্চের কমিউনিস্ট দলের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। ১৯৫০ সালে ‘লেনিন পিস প্রাইজ~ লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের ৮ এপ্রিল এই মহৎ শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন। পিকাসোর মৃত্যুর পর ১৯৯৬ তাঁকে নিয়ে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র ‘সারভাইভিং পিকাসো।~ ১৯৯৩ সালে ‘পিকাসো এট দ্যা ল্যাপিন অ্যাজাইল~ নামের একটি নাটকও নির্মিত হয়, যাতে এই মহৎ শিল্পীর জীবনী সুন্দরভাবে চিত্রায়ন হয়েছে। ২০১০, ২০১১ ও ২০১২তেও তার একক চিত্রপ্রদর্শনী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে।


পিকাসো প্রকৃত পরিশ্রমী শিল্পী। তার ৫০০০০ হাজারেরও বেশি চিত্রকর্ম আছে। যার মধ্যে পেইন্টিঙের সংখ্যা ১৮৮৫টি, ভাস্কর্য রয়েছে ১২২৮টি, সিরামিক শিল্পকর্ম আছে ২৮৮০ আর এছাড়া ১২০০০ হাজারেরও বেশি ছবি ও রাফ ছবি রয়েছে। তার মৃত্যুর সময় অনেক ছবিই নিজস্ব সংরক্ষণে ছিল। আর কিছু ছিলো বাজারে বিক্রির জন্য। যদিও এসব তার বিক্রির প্রয়োজন ছিল না। তারপরও পিকাসোর সংগ্রহশালা তার সময়কালীন শিল্পীদের চেয়ে নিসন্দেহে ব্যাপক। পিকাসোর মৃত্যুর পর ফ্রাঞ্চ সরকারের বকেয়া রাজস্ব তাঁর চিত্রকর্মের বিনিময়ে আদায় করা হয়। এই শিল্পকর্মগুলো পিকাসোর মৌলিক কাজ বলে বিবেচিত। স্পেন ২০০৩ সালে পিকাসোর সম্মানে ‘মাউসে পিকাসো মালাগা~ নামের একটি মিউজিয়াম পিকাসোর জন্মস্থানে নির্মাণ করে। এতে পিকাসোর কৈশরের অঙ্কিত চিত্রকর্ম স্থানে পেয়েছে। উঠে এসেছে বালক পিকাসোর জীবন।

Comments